জিংকসমৃদ্ধ ধান শরীরে জিংকের অভাব
পূরণে টেকসই সমাধান
ড. মো. শাহজাহান কবীর১ ড. মো. আবদুল কাদের২ কৃষিবিদ এম আব্দুল মোমিন৩
ধান আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য। অন্য পুষ্টিকর খাবার জোগাড় করতে না পারলেও এদেশের প্রায় সবাই প্রতিদিন কম-বেশি ভাত খেয়ে থাকে। প্রাত্যহিক চাহিদার শতকার ৭০-৭৫ ভাগ শর্করা, ৬০-৬৫ ভাগ প্রোটিন, ৮ ভাগ ফ্যাট, ৫.৮ ভাগ ক্যালসিয়াম এবং ৯১.৬ ভাগ ফসফরাস চাল থেকে পাওয়া যায়। দেশে মাথাপিছু চালের গ্রহণ হার হিসেবে দৈনিক যে পরিমাণে পুষ্টি আমরা চাল বা ভাত থেকে পাই তা কোনভাবেই আমাদের চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট নয়। সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, প্রতি ১০০ গ্রাম চাল থেকে আমরা মোটামুটি ১২৯ কিলোক্যালরি শক্তি, ৭৮.০৯ গ্রাম শর্করা, ৭.১২ গ্রাম প্রোটিন, ০.২৮ গ্রাম চর্বি, ১.৩০ গ্রাম আঁশ ০.০৭ মি. গ্রাম থায়ামিন, ০.০১৫ মি. গ্রাম রিবোফ্লাভিন, ১.০৯মি. গ্রাম জিংক, ২৮ মি. গ্রাম ক্যালসিয়াম, ০.৮০ মি. গ্রাম আয়রন, ২৫ মি. গ্রাম ম্যাগনেসিয়াম ইত্যাদি অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য উপাদান পেয়ে থাকি। যদিও জাতভেদে এই পরিসংখ্যানের তারতম্য হতে পারে।
বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনের কাজ চলমান রয়েছে। গবেষণায় দেখা যায় মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট-এর অভাব অন্যতম। বাংলাদেশে ৫ বছরের কমবয়সী শিশুর প্রায় দু-তৃতীয়াংশই কোনো না কোনো মাত্রার অপুষ্টিতে ভুগছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে রচিত ১৯৭২ সালের সংবিধানে নাগরিকের পুষ্টি উন্নয়ন কে রাষ্ট্রের প্রাথমিক কর্তব্য হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। ১৯৭২ এর সংবিধানে উল্লেখ করা হয় “জনগণের পুষ্টিস্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনকে রাষ্ট্রের প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবে”।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা এবং এসডিজির ২নং অভীষ্ট অর্জন কে সামনে রেখে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান যেমন- জিংক, আয়রন, প্রোটিন, ভিটামিন ও মিনারেলসসহ শরীরের অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যোপাদানগুলো দেহের প্রয়োজন অনুসারে চালে সংযোজন, সরবরাহ বা পরিমাণে বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে কাজ করছে। পুষ্টিসমৃদ্ধ জাত উদ্ভাবনে বিশ্বের সর্বাধুনিক বায়োফর্টিফিকেশন ও জিএম প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। কেননা দেশের সাধারণ মানুষ দুধ-ডিম, মাছ ও মাংসসহ অন্যান্য পুষ্টিকর খাবার কিনতে না পারলেও তারা ভাত নিয়মিত খেতে পারছে। এজন্য জিংক, আয়রন, প্রোটিন, এন্টি-অক্সিডেন্ট, গামা এমাইনো বিউটারিক এসিড (এআইএ) ও প্রো-ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ গোল্ডেন রাইস এবং স্বল্প জিআই সম্পন্ন ডায়াবেটিক ধানসহ বিভিন্ন পুষ্টিকর ধান উদ্ভাবন করেছে ব্রি। এর মধ্যে জিংকসমৃদ্ধ জাত উদ্ভাবনে ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছেন বিজ্ঞানীরা।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে পাঁচ বছরের নিচে এমন বয়সী ৪৬ শতাংশ শিশু জিংক স্বল্পতায় ভুগছে। আবার বিভিন্ন বয়সী ৫৭ শতাংশ নারীর রয়েছে জিংক স্বল্পতা। নারী-পুরুষ ও শিশু মিলে গড়ে প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ জিংকের অভাবে ভুগছে। এর সমাধান খুঁজতেই ভাতের মাধ্যমে জিংকের অভাব দূর করতে ৭টি জিংকসমৃদ্ধ ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান এ পর্যন্ত আরো ১৬টি বায়োফরটিফাইড জিংকসমৃদ্ধ ফসলের জাত উদ্ভাবন করেছেন।
ভাত মানুষের প্রধান খাদ্য হওয়ায় জিংকসমৃদ্ধ ধানের মাধ্যমে জিংকের অভাব পূরণ একটি টেকসই সমাধান। জিংকসমৃদ্ধ ধানের ভাত খেয়ে জিংকের দৈনিক চাহিদার ৫০-৭০ শতাংশ পূরণ করা সম্ভব। কৃষকের মাঝে এ জাতগুলোর দ্রুত সম্প্রসারণ করা হলে এদেশের পুষ্টিহীনতা তথা জিংকের অভাব পূরণ সহজ ও টেকসই হবে। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, বাংলাদেশের উচ্চফলনশীল ধানের সঙ্গে পরাগায়ন ঘটিয়ে জিংকসমৃদ্ধ ধানের জাতগুলো উদ্ভাবন করা হয়েছে। এ ধান থেকে কৃষকরা নিজেরাই বীজ তৈরি করে রোপণ করতে পারবেন। অধিক পরিমাণে জিংক থাকা সত্ত্বেও এই ভাতের স্বাদ ও রঙয়ের কোনো তারতম্য হয় না।
জিংক মানুষের জন্য একটি অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য উপাদান যা দেহে এন্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, শর্করার ভাঙন, দেহ কোষের বৃদ্ধিতে এবং পলিপেটাইড গঠনে, গ্যাসটিন নিঃসরণের মাধ্যমেই স্বাদের অনুভূতি তৈরি বা রুচি বাড়াতে ভূমিকা রাখে। হাড়ের বৃদ্ধির জন্য কেরোটিনয়েড তৈরি ও তার পরিপক্বতা, ইনসুলিন তৈরি, ত্বকের ক্ষত সারানো ও রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি কাজে জিংকের অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
মানবদেহে ২০০ এরও বেশি এনজাইমের নিঃসরণে সহযোগিতা করে জিংক। যা দেহের অনেক বিপাকীয় কাজে এটি অংশ নেয়। জিংকের অভাবে মানুষের শরীরে নানাবিধ অভাবজনিত লক্ষণ দেখা দিতে পারে। তার মধ্যে রয়েছে খাটো বা বামন হওয়ার প্রবণতা, শারীরিক বৃদ্ধি হ্রাস পাওয়া, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া, নিউরোলজিক্যাল সমস্যা সৃষ্টি, ডায়রিয়া, এলার্জি, চুলপড়া, ক্লান্তি অনুভব হওয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দিতে পারে। উঠতি বয়সের কিশোর-কিশোরীদের বেড়ে উঠার সময়ে জিংকের অভাব হলে শিশু-কিশোররা বেটে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। কিন্তু জিংক সমৃদ্ধ জাতের ভাত খেলে শরীরে জিংকের প্রয়োজনীয় চাহিদা মিটে যাবে এবং বেটে হবার সম্ভাবনা থাকবে না। ব্রি উদ্ভাবিত জিংকসমৃদ্ধ ধানগুলোর বৈশিষ্ট্য সারণি দ্রষ্টব্য। বেসরকারি সংস্থা হারভেস্টপ্লাস (ঐধৎাবংঃ চষঁং) এর তথ্যানুযায়ী জিংকসমৃদ্ধ এসব ধানের আবাদ এলাকা ও উৎপাদন দুটোই ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।
জিংকসমৃদ্ধ চাল নিয়মিত গ্রহনের মাধ্যমে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক লোকের জিংক এর চাহিদা কিভাবে পূরণ করা সম্ভব তার একটি হিসাব (দৈনিক গড়ে চাল গ্রহনের পরিমান ৩৬৭ গ্রাম হিসাবে) বিজ্ঞানীরা উপস্থাপন করেছেন। একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের শরীরে জিংকের দৈনিক চাহিদা ১১ মিলিগ্রাম এবং প্রাপ্ত বয়স্ক নারীর দৈনিক চাহিদা ৮ মিলিগ্রাম। ব্রি উদ্ভাবিত জিংক চালে জিংকের পরিমাণ ২৪ মি.গ্রা./কেজি বা তার অধিক। সুতরাং ৩৬৭ গ্রাম চালে জিংকের পরিমাণ হবে ৮.৮১ মি. গ্রা.। যার মধ্যে রান্নার সময় নষ্ট হয় ১১% এবং জিংকের ইরড়ধাধরষধনরষরঃু ৯১%। রান্না ও হজমের পর ৩৬৭ গ্রাম চাল হতে শরীর জিংক পায় ৭.১৪ মি. গ্রাম। অর্থাৎ মানুষের শরীরে জিংকের যে পরিমাণ চাহিদা রয়েছে জিংক চাল গ্রহণের পরিমাণের তারতম্যের কথা বিবেচনা করে বলা যায় জিংকসমৃদ্ধ চাল নিয়মিত গ্রহণের মাধ্যমে দৈনিক জিংকের চাহিদার প্রায় ৫০-৭০% পূরণ করা সম্ভব।
বাজারে জিংকসমৃদ্ধ চালের সরবরাহ বাড়াতে জিংকসমৃদ্ধ জাতসমূহ মাঠ পর্যায়ে দ্রুত সম্প্রসারণ ও সরকারিভাবে উৎপাদিত জাতগুলোর ধান ক্রয় ও বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। এজন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহযোগিতায় ব্রি সদর দপ্তর ও ১১টি আঞ্চলিক কার্যালয়ের মাধ্যমে কৃষকের মাঠে প্রদর্শনী স্থাপন করে বীজের প্রাপ্যতা সহজলভ্য করতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণ টিএলএস উৎপাদন করে কৃষকদের মাঝে সরাসরি বিতরণ করতে হবে। ব্রিডার বীজ উৎপাদন করে বিএডিসি ও বিভিন্ন বীজ কোম্পানিকে বিতরণ এবং তাদের মাধ্যমে পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদন করে কৃষকদের মাঝে বিতরণ করার ব্যবস্থা নিতে হবে। ইফরি-র অর্থায়নে পরিচালিত হারভেস্ট প্লাস প্রকল্পের মাধ্যমে বীজ উৎপাদন করে বিনামূল্যে কৃষকের মাঝে সরাসরি বিতরণ এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে কৃষকের মাঠে বীজ উৎপাদন করে প্রতিবেশী কৃষকদের মাঝে বিতরণ করা যেতে পারে।
পরিশেষে বলতে চাই, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য খাদ্য গ্রহণে আমাদের অবশ্যই সচেতন হতে হবে। জিংকসহ অন্যান্য পুষ্টিকর চালের ভাত গ্রহণে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এ কাজে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি আমাদের শিক্ষিত ও সুশীল সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রোগ্রাম যেমন- OMS,BGF,BGD, Social Networkঙগঝ, ইএঋ, ইএউ, ঝড়পরধষ ঘবঃড়িৎশ ইত্যাদি এর মাধ্যমে দুস্থ ও গরিবদের মাঝে জিংকসমৃদ্ধ ধানের চাল বিতরণ করা হলে খাদ্য চাহিদা ও জিংকের ঘাটতিজনিত পুষ্টির অভাব পূরণ হবে। তাহলেই বঙ্গবন্ধুর কাক্সিক্ষত জনগণের পুষ্টিস্তর উন্নয়নের মাধ্যমে জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
লেখক: ১মহাপরিচালক (চলতি দায়িত্ব), ২প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং ৩ঊর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। মোবাইল : ০১৭১৬৫৪০৩৮০, ইমেইল-smmomin80@gmail.com